জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট এলাকায় ঘুমিয়ে থাকা গেটম্যানের গাফিলতিতে ট্রেনের ধাক্কায় ১২ বাসযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তিনজন। শনিবার সকালের এ দুর্ঘটনায় রেললাইনে থাকা বাসটি ছেঁচড়ে আধা কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। এতে করে প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের সবরকম ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ থেকে বিকালে ফের চালু হয়। দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে আসা বাঁধন নামে একটি বাস যাত্রী নিয়ে হিলি স্থলবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট অতিক্রম করার সময় গেটম্যান গেট না ফেলার কারণে বাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। সে সময় দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন সজোরে ধাক্কা দেয় বাসটিকে।
ট্রেন বাসটিকে রেললাইনে ঘষতে ঘষতে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায়। এ সময় বাসে থাকা ১০ যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় পাঁচজন। জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা হতাহতদের উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে পাঠায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বাসটির হেলপার সোহেল হোসেন জানান, ওই রেলগেটে কোনো গেটম্যান ছিল না, বাসটিতে ২০-২২ জন যাত্রী ছিল। বাসটি দুর্ঘটনার মুখে পড়বে, এমন আশঙ্কা থেকে আমিসহ কয়েকজন যাত্রী বাসটি থেকে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচাই। নিহতদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, বাসচালক সদর উপজেলার হারাইল গ্রামের মামুনুর রশিদ, হিচমী গ্রামের মানিকের ছেলে রমজান, পাঁচবিবি উপজেলার আটুল গ্রামের সরোয়ার হোসেন, আরিফুর রহমান রাব্বি, আক্কেলপুর উপজেলার চকবিলা গ্রামের দুদু কাজীর ছেলে সাজু মিয়া ও নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বিজয়কান্দি গ্রামের বাবু। আহত তিনজন হলেনÑ পাঁচবিবি উপজেলার ফারুখ হোসেন, একই উপজেলার সিরাজুল ইসলামের ছেলে জিয়া ও টাঙ্গাইলের মাটিকাটা গ্রামের শুকুর আলীর জুলহাস।
জয়পুরহাট জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম জানান, আহতদের প্রথমে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে ও পরে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম জানান, নিহত ১০ জনের লাশ হাসপাতাল মর্গে আছে। আহত পাঁচজনকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে পাঠানো হলে পথে দুজনের মৃত্যু হয়। জেলা পুলিশ সুপার সালাম কবির জানান, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও গ্রামবাসীরা মিলে আহতদের উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে বিভাগ দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পার্বতীপুর রেললাইনের পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান জানান, গেটম্যান না থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্ত করার পর আসল ঘটনা জানা যাবে।
তদন্ত কমিটি গঠন : জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজা হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, পাঁচবিবি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ইশতিয়াক আলম ও জয়পুরহাট সড়ক ও জনপথের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আজিজুল হক। তাদের আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে রেলওয়ে বিভাগের পক্ষ থেকে বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিও আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী আশিকুর রহমান, বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহিম ও বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার শাকিল আহম্মেদ।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহিম জানান, অনুমোদিত এ রেলগেটে দুজন স্থায়ী ও একজন চুক্তিভিত্তিক গেটকিপার নিয়োজিত রয়েছে। তারা ৮ ঘণ্টা করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করে। ঘটনার সময় দায়িত্বে ছিল গেটকিপার নয়ন হোসেন। দুর্ঘটনার পর থেকে সে পলাতক থাকলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রেল চলাচল শুরু : এদিকে ঘটনার ৮ ঘণ্টা পর বিকাল ৩টা থেকে আবার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানান রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন। জয়পুরহাট স্টেশন মাস্টার হাবিবুর রহমান জানান, সকালে দুর্ঘটনার পর থেকে এ রুটে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের সব ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পার্বতীপুর থেকে একটি রিলিফ ট্রেন এসে ঘটনাস্থল থেকে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের লাইনচ্যুত বগি সরিয়ে নেয়। এতে বিকাল ৩টা থেকে এ লাইনে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।