যারা ছিলেন জাতির পিতার ভ্যানগার্ড, দেশকে মেধাশূন্য করতে, একাত্তরের এই দিনে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে পায়ে পায়ে সবার গন্তব্য সেই বধ্যভূমি, যেখানে বাঙালির সূর্য সন্তানদের হত্যা করে ফেলে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, চালিয়েছিল পৃথিবীর নৃশংস এক গণহত্যা।
সে ঘটনার ৫০ বছরে শ্রদ্ধা অবনত গোটা জাতি। সোমবার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় জাতি স্মরণ করে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বুদ্ধিজীবীদের শপথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র দুদিন আগে এদেশের দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ হাজারো বুদ্ধিজীবীকে। সেই থেকে ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, পালন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে।
দিনটি উপলক্ষে সোমবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম শামীম-উজ-জামান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। অন্য বছর এই দিনটিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও করোনাভাইরাস মহামারির এ সময়ে ভাইরাসের বিস্তার রোধে অনেক রাষ্ট্রীয় আয়োজনই সীমিত করে আনতে হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে মন্ত্রিসভার প্রতিনিধিরা এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে জাতির মেধাবী সন্তানদের স্মরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাবউদ্দিন, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা, ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হক ভোরেই মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। একে একে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যরা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
সকাল ৯টার দিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান ওবায়দুল কাদের। এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাজাহান খান ও আবদুর রহমান, তথ্যমন্ত্রী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এসএম কামাল হোসেন ও মির্জা আজম, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন ফরাজী, আনিসুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর একে একে কেন্দ্রীয় ১৪ দল, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর ও দক্ষিণ), আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠন ও স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অন্য বছর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান চলে যাওয়ার পর সর্বস্তরের জনগণের জন্য মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, এবার সে বিধিনিষেধ সেভাবে ছিল না। পতাকা আর ফুল হাতে সকাল থেকেই নানা বয়সের মানুষ জড়ো হয় শহীদ বেদিতে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিও সকাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষের ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য টিভি চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। এ ছাড়া দেশব্যাপী আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানি বাহিনী ওই নিধনযজ্ঞ চালায়; তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পর যেন বাংলাদেশ যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত করে কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছে বাংলাদেশ। কলঙ্ক মোচনের পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এখন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিরও দাবিদার। এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। আগামী বছর স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ।
বুদ্ধিজীবী হত্যা বাস্তবায়ন করেছিলেন যারা, বিচারে তাদের ফাঁসির রায় হলেও কারও কারও ফাঁসি কার্যকর করা যায়নি। সাধারণ মানুষের দাবি, মৃত্যুঞ্জয়ী এসব সূর্য সন্তানের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার আরও সাহসী ভূমিকা নেবে এমন চাওয়া তরুণ প্রজন্মের।